ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা নিহতদের জন্য ক্ষমা চাইবেন না বলে জানিয়েছেন। লন্ডনের দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট ও বার্তা সংস্থা রয়টার্স-কে দেওয়া পৃথক সাক্ষাৎকারে তিনি এই অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের মুখে পতনের পর থেকে ভারতে অবস্থান করছেন হাসিনা। দীর্ঘ ১৫ বছর দেশ শাসনের পর গত ৫ আগস্ট তিনি ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেন। এরপর এটাই তার প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার।
আরো পড়ুন
সাক্ষাৎকারে হাসিনা দাবি করেন, বিক্ষোভ দমনের সময় নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি চালানোর নির্দেশ তিনি দেননি। বরং তার ভাষায়, “আমাদের অনেক সন্তান, ভাই-বোনের মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত। কিন্তু আমি কোনো সময় প্রাণঘাতী অভিযানের নির্দেশ দিইনি।”
তিনি আরও বলেন, আন্দোলনের সময় সহিংসতার বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটেছিল মাঠপর্যায়ের “নিরাপত্তা বাহিনীর শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে।”
‘দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট’ লিখেছে, নিহতদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইতে বলা হলে হাসিনা দৃঢ়ভাবে জানান, তিনি ক্ষমা চাইবেন না। সংবাদমাধ্যমটির ভাষায়, “লৌহ মুষ্টিতে বাংলাদেশ শাসন করা নেতা এখন ভারতের নির্বাসনে, কিন্তু এখনও নিজের পদক্ষেপকে ন্যায়সঙ্গত বলে দাবি করছেন।”
অন্যদিকে রয়টার্স-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা একটি “ভয়াবহ ভুল”। তার মতে, “দলটিকে নিষিদ্ধ করা শুধু অন্যায় নয়, বরং আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।” তিনি উল্লেখ করেন, কোটি কোটি মানুষ আওয়ামী লীগের সমর্থক, তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হলে গণতন্ত্র কার্যকর থাকবে না।
তিনি জানান, দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর আওয়ামী লীগের লাখো কর্মী-সমর্থক আগামী জাতীয় নির্বাচন বর্জন করবেন। হাসিনার দাবি, “আমরা অন্য কোনো দলকে সমর্থন করতে বলিনি। আমরা শুধু চাই, সংবিধান ও বৈধ সরকারের অধীনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হোক।”
হাসিনা বলেন, তিনি দেশে ফিরবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত “সরকার বৈধ, সংবিধান রক্ষিত ও আইন-শৃঙ্খলা বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত না হয়।” তার ভাষায়, “আমি দেশে ফিরতে চাই, কিন্তু শুধু তখনই যখন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সাংবিধানিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।”
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বর্তমানে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই এই সরকার দেশ পরিচালনা করছে। তারা আগামী ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে। তবে ঐ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিতে পারবে না।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্টের মধ্যে অন্তত ১,৪০০ মানুষ নিহত হন— যা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা। হাসিনা এই সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তার ভাষায়, “১,৪০০ নিহতের সংখ্যা অতিরঞ্জিত হতে পারে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি যাতে প্রাণহানি কম হয়।”
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের উপ-আঞ্চলিক পরিচালক বাবুরাম পান্ট তখন মন্তব্য করেছিলেন, “বিক্ষোভ দমন বাংলাদেশের সরকারের অসহিষ্ণুতার নির্মম উদাহরণ।” জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্কও বলেছিলেন, “ছাত্র আন্দোলনের ওপর হামলা নিন্দনীয় ও অগ্রহণযোগ্য।”
নিজের দেশত্যাগ প্রসঙ্গে হাসিনা বলেন, “আমি ৫ আগস্ট দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলাম। দেশে থাকলে শুধু আমার নয়, আমার আশপাশের মানুষের জীবনও হুমকির মুখে পড়ত।”
তিনি আরও বলেন, “আমি চাই আমাকে এমন নেতা হিসেবে মনে রাখা হোক, যিনি সামরিক শাসনের পর দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছিলেন এবং কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করতে সাহায্য করেছিলেন।”
সাক্ষাৎকারে হাসিনা স্বীকার করেন, তার দল ভবিষ্যতে সরকারে বা বিরোধী দলে— যে কোনো অবস্থানেই দেশের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখবে। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ভবিষ্যতে “তার পরিবারের ওপর নির্ভর করবে না।”
তার ভাষায়, “এটা আমার বা আমার পরিবারের বিষয় নয়। আমরা সবাই চাই বাংলাদেশের সাংবিধানিক শাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক। কোনো ব্যক্তি বা পরিবার দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে না।”






